চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দুর্গম জঙ্গল ছলিমপুরে ত্রাসের রাজত্ব কারো করেছে রোকন বাহিনী। শতাধিক সদস্যের সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলে পাহাড়ি জনপদ নিয়ন্ত্রণ করছেন সদ্য বহিষ্কৃত যুবদল নেতা রোকন উদ্দিন। তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, দখলসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী জানান, গত বছরের ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জঙ্গল ছলিমপুরের অধিকাংশ পাহাড়ি এলাকা দখলে নেন রোকন উদ্দিন। এর পর থেকেই সংঘাত-সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সব শেষ শনিবার প্রতিপক্ষ ইয়াছিন বাহিনীর এলাকায় হানা দেয় রোকন বাহিনী। সংঘর্ষ ও গোলাগুলির এক পর্যায়ে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় রোকন বাহিনীর সদস্য খলিলুর রহমান কালুকে। এ নিয়ে ১০ মাসে জঙ্গল ছলিমপুরে নিহত হলেন চারজন। তাদের তিনজনই রোকন বাহিনীর সদস্য। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তারা প্রাণ হারান। আরেকজনকে রোকন বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করে বলে জানা গেছে।
রোকনকে বহিষ্কার করেছে যুবদল
গত শনিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় রোকন উদ্দিনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে যুবদল। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে সোমবার রাতে তাঁকে উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আব্দুল মোনায়েন মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নের সিদ্ধান্তে সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়। একই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সহসভাপতি মোকাম্মেল হক তালুকদারকে বহিষ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গত শনিবার ভোরে জঙ্গল ছলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকা ও আলিনগর দখলকে কেন্দ্র করে আরেক সন্ত্রাসী ইয়াছিন বাহিনীর সঙ্গে রোকন বাহিনীর সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে ইয়াছিন বাহিনীর হাতে নিহত হন রোকন বাহিনীর সদস্য খলিলুর রহমান কালু। আহত হন ২০ থেকে ২৫ জন। এ ঘটনায় রোববার তিনটি মামলা হয়। এরপর গত সোমবার রাতে রোকন উদ্দিনকে আসামি করে একটি মামলা হয় সীতাকুণ্ড মডেল থানায়।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. মজিবুর রহমান বলেন, জঙ্গল ছলিমপুরে শনিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে চারটি। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার তিনজন।
জঙ্গল ছলিমপুরের আলিনগরের ৩২শ একর পাহাড়ি এলাকার দুই যুগ ধরে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আরেক সন্ত্রাসী গ্রুপ ইয়াছিন বাহিনীর হাতে।
রোকন বাহিনীর হাতে ওয়াকিটকি
রোকন বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে অস্ত্রধারী ৫৫ জনের হাতে রয়েছে ওয়াকিটকি। এর মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে পুরো জঙ্গল ছলিমপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখেন তারা। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি খুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা সাদেক ও গোলাম গফুরের দিগফরের বাহিনীও। আগে তারাই জঙ্গল ছলিমপুর নিয়ন্ত্রণ করত।
গত বছরের আগষ্টে জঙ্গল ছলিমপুর পাহাড়ি এলাকা দখলে নিয়েই চাঁদাবাজি শুরু করেন রোকন। ওই এলাকায় অন্তত ১৬ হাজার পরিবার রয়েছে। রোকন প্রতি ঘর থেকে উন্নয়ন ফির নানে ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করেন বলে বসতিরা জানিয়েছেন।
পরিচয় গোপন রেখে এক নারী জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রোকনের বাহিনী এসে তাদের কাছ থেকে উন্নয়ন ফির নামে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় তাঁর স্বামীকে তুলে নিয়ে মারধর করা হয়। পরে গরু বিক্রি করে টাকা দেন তারা। এ রকম ৪-৫ হাজার পরিবার থেকে এ টাকা আদায় করেছে রোকন বাহিনী।
গত জুলাইয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুস সালামকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় রোকন বাহিনী। আবদুস সালাম বলেন, দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন পরিবারের
সদস্যরা। তবে এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তাঁকে ফিরিয়ে দেয়। থানায় দায়িত্বরতরা বলেন, মামলা করলে তিনি আবার হামলার শিকার হতে পারেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১৪ মাসে এ রকম শতাধিক জিম্মি ঘটনা ঘটিয়েছে রোকন বাহিনী। ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
১০ মাসে ৪ খুন
জঙ্গল ছলিমপুরে গত আড়াই বছরে ১০ বারের বেশি গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হয়েছে কমপক্ষে পাঁচবার। এছাড়া গত ১০ মাসে নিহত হয়েছে চারজন।
গত ২ জানুয়ারি জঙ্গল ছলিমপুরে বিএনপির উপজেলা কমিটির সাবেক বন ও পরিবেশ-বিষয়ক সম্পাদক নীর আরমানকে হত্যা করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি একই এলাকায় মোহাম্মদ মাসুদ নামে বিএনপির আরেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সিডিএ আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন এলাকা থেকে বৃদ্ধ আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সবশেষ গত শনিবার নিহত হন খলিলুর রহমান কালু।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, জঙ্গল ছলিমপুরে ‘এখন টিভি’র দুই সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও চট্টগ্রাম টেলিভিশন রিপোর্টার্স নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদানকালে তিনি এ আশ্বাস দেন।
পুলিশ সুপার বলেন, ওই এলাকা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, যা প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকদের সহযোগিতায় সন্ত্রাসীদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে।’ এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিরাজুল ইসলাম এবং টিভি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)। গতকাল বিকেলে নগরের চেরাগী পাহাড় এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করা হয়। সিইউজের সভাপতি রিয়াজ হায়দারের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভর সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শহিদুল উল আলম, মোস্তাক আহমদ, নাজিম উদ্দিন শ্যামল, আসিফ সিরাজ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেব দুলাল ভৌমিক, যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, রুনা আনসারী, শফিক আহমেদ সাজিব প্রমুখ।
সূত্র: সমকাল ৮১০২৫

